Saturday, April 28, 2007
An Interview with Bangladeshi Film maker Tareque Masud
বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ। আদম সুরত, মুক্তির গান, মুক্তির কথা, নারীর কথাসহ বেশ কয়েকটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করে মুভি বোদ্ধাদের শ্রদ্ধার আসনে স্থান করে নিয়েছেন। নাইন ইলেভেন পরবর্তী পরিস্থিতিতে মাটির ময়না মুভি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে এর বিষয়ের কারণে। মাটির ময়নার পর নির্মাণ করেছেন অন্তর্যাত্রা। কাজ করছেন ৪৭-এর দেশ বিভাগের সময়ের ওপর নির্মিতব্য নতুন মুভি নিয়ে। তিন বছরের ডেস্ক ওয়ার্ক শেষ করার পর আগামী আগস্টে শুরু হবে এর শুটিং। বড় আয়োজনের এ মুভিটি মাটির ময়নার প্রিকোয়েল/সিকোয়েল। ডিরেক্টর হিসেবে তার বেড়ে ওঠা, মুভি নির্মাণ, আগ্রহ ও অনুসন্ধান নিয়ে কথা বলেছেন যায়যায়দিনের সঙ্গে।
সাক্ষাতকার নিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ। ছবি তুলেছেন হাসান বিপুল
সিনেমায় আপনার শুরুর দিকটা কেমন ছিল?
আমি কাকতালীয়ই বলবো, আমার ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়নি। পড়েছি মাদ্রাসায়। ওখানে তো ছবি আকাই নিষিদ্ধ ছিল, সিনেমা তো তার চেয়েও বেশি। যে বয়সে মানুষ প্রচুর মুভি দেখে, সে বয়সে আমার মুভি দেখাই হয়নি। এ জন্যই হয়তো সিনেমার প্রতি আমার বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। যখন আমি মাদ্রাসা থেকে সরাসরি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে এলাম তখন কাকতালীয়ভাবে ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হলাম। এতো অল্প বয়সে ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে জড়িত হওয়ার সুযোগ হয় না কারো। সাধারণত ইউনিভার্সিটিতে ওঠে ফিল্ম সোসাইটিতে যুক্ত হয় লোকে। কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারেই ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে আমার যোগাযোগ। আমি আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে পড়েছি। আমার তথাকথিত বাণিজ্যিক বা জনপ্রিয় মুভি দেখার সুযোগ হয়নি। আমার শুরুটা হয়েছে ভালো মুভি দেখার মাধ্যমে আর তা ছিল সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী উপন্যাস পড়ে শুরু হয়। কিন্তু আমি মুভি দেখে বিভূতিভূষণ পড়েছি। যারা মাটির ময়না দেখেছে তারা বুঝতে পারবে এটা সত্যজিৎ রায়ের প্রতি একটা টৃবিউট। মাদ্রাসায় আমাকে মুভি সম্পর্কে যে ধারণা দেয়া হয়েছে তাতে এটা যে শুধু বেশরিয়তি ব্যাপার তাই নয়, নোংরা নাচ-গান, হাবিজাবি নিয়ে তৈরি চটুল জিনিস। বুঝলাম, সিনেমা জীবনের কতো কাছাকাছি হতে পারে। এটা আমার জীবনের একটা বিরাট টার্নিং পয়েন্ট। কিছু প্রামাণ্যচিত্র দেখারও সুযোগ হলো। এর সঙ্গে যুক্ত হলো ইতিহাস নিয়েও আমার আগ্রহ। যে বয়সে বই পাঠ করাটা চাপিয়ে দেয়া বিভীষিকা, সে বয়সে বই পাঠ থেকে বঞ্চিত ছিলাম বলে ইন্টারমিডিয়েট বয়স থেকে অমনিভোরাস (সর্বভুক) পাঠক হয়ে উঠেছিলাম, যা পাই তাই পড়ি।
আমি কিন্তু নির্গান ও নির্জ্ঞান। কিন্তু আমার পরিবার খুবই সাঙ্গীতিক, তাও আবার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। মুক্তির গানের মূল ভোকালিস্ট মাহমুদুর রহমান বেণু আমার বড় কাকার ছেলে। এ সাঙ্গীতিক পরিবেশ আমার জন্য সৌভাগ্য। মাদ্রাসায় ছবি আকা নিষিদ্ধ ছিল বলে হয়তো আর্ট কলেজের প্রতি আমার একটা অদম্য আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে আমাকে বেশি পাওয়া যেতো আমার ডিপার্টমেন্ট অপেক্ষা আর্ট কলেজে। আমার বন্ধু-বান্ধব বেশি ছিল সেখানকার। আমি হিস্টৃতে ছিলাম। কিন্তু ঢালী আল মামুন, শিশির ভট্টাচার্য, ওয়াকিল, হাবিব, নোটনÑ এরা আমার বন্ধু ছিল। তাদের যারা শিক্ষক ছিলেন তাদের সঙ্গেও আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তখন আর্ট কলেজে এতো নিয়মিত ছিলাম যে, ওখানকার অনেক ছাত্র মনে করতো আমি বোধহয় আর্ট কলেজের ছাত্র। ওখানকার অনেক ছাত্র অপেক্ষা আমি ছিলাম নিয়মিত। সেই সূত্রে কিন্তু সুলতানের প্রতি আমার আগ্রহ। ইউনিভার্সিটির ছাত্র অবস্থায় একজন চিত্রশিল্পীর ওপর মুভি বানানো আমার ধৃষ্টতা বা দুঃসাহস।
তখনই কি আহমদ ছফার সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা?
হ্যা। তখন সারাক্ষণ আমরা ছফাভাইয়ের কথা শুধু যে শুনেছি তাই নয়, গিলেছিও। তার বাইরের ব্যাপারটায় আমরা যতোটা না ভুলেছি তার চেয়ে বেশি তার ভেতরটা আমাদের স্পর্শ করেছে। তিনি যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শেক্সপিয়ার কোট করে যাচ্ছেন, ফাউস্ট বলে যাচ্ছেন, কালিদাস বলে যাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ বলে যাচ্ছেন, ফটোগ্রাফিক মেমোরি থেকে ইতিহাস বলে যাচ্ছেন, ভলটেয়ার রুশো থেকে শুরু করে সবকিছু, সেটা আমাদের ভেতর গেথে যাচ্ছে। লাইব্রেরি চত্বরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার মোনলোগ চলছে আর আমরা শুনে যাচ্ছি। সুলতান সম্পর্কে আগ্রহ ছফাভাইয়ের কারণেই।
আমার সঙ্গে যারা চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন করতেন তাদের মধ্যে অনেকে প্রতিভাবান ছিলেন বলে মনে করি। কিন্তু কৃজে টিকে থাকার মন-মানসিকতা তাদের ছিল না। আমাদের হয়তো স্কোর কম হয়েছে কিন্তু আমরা টিকে থেকেছি।
খসরু ভাইয়ের (মোহাম্মদ খসরু) কথা বলতে হয়। তিনি তো একটা প্রতিষ্ঠান। তার পকেট থেকেই আমরা সব বেরিয়েছি।
চলচ্চিত্র সংসদের সঙ্গে ছিলাম কিন্তু কখনোই ভাবিনি মুভি নির্মাণ করবো। যে কারণে সাহিত্যের সঙ্গে আছি, লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে আছি, চিত্রকলার সঙ্গে আছি, সঙ্গীতের সঙ্গে আছি, সে কারণেই চলচ্চিত্রের সঙ্গে ছিলাম। সঙ্গীতে আশির দশকে যারাই কাজ করেছেন, যারা তাত্ত্বিকভাবে বা প্র্যাকটিকালি যুক্ত ছিলেন তাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমি সাঙ্গীতিক পরিম-লে ততপর ছিলাম, সক্রিয় ছিলাম। সিনেমার জন্য বোধহয় এগুলো কাজে লাগে। এটা জ্যাক অফ অল ট্রেডসের মতো কাজ। চিত্রকলা, সাহিত্য সবকিছুই সামান্য জানা। এ জানার সুযোগ হয়েছিল ওই সম্পৃক্তির মাধ্যমেই। এটাই হয়তো পরে সিনেমায় আমাকে সাহায্য করেছে। যেহেতু সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ওই সামান্যের বাইরে আমার সুযোগ হয়নি, সিনেমায় এসে সেটা কাজে লেগেছে। সুলতানকে নিয়ে মুভি করতে এসে আমি তখনো ভাবিনি, আমার পেশা হবে চলচ্চিত্র নির্মাণ।
কতো সালে আদমসুরত শুরু করেছিলেন?
শুরু করেছিলাম ১৯৮২ সালে এবং শেষ করলাম ১৯৮৯-এ। মাঝখানে ভিডিওতে একটা মুভি করেছিলাম, সোনার বেড়ি। নারী নির্যাতন ইত্যাদি নিয়ে ডকুমেন্টারি। তখনো অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে বিটিভির বাইরে প্রাইভেটলি ভিডিও ফরমাটে কোনো মুভি হয়নি। সুলতান বানিয়ে কিন্তু আমি রণকান্ত হয়ে রণে ভঙ্গও দিয়েছিলাম। মুভিটা শেষ করলাম সাত বছর লাগিয়ে। যা হয় ওই বয়সে, ক্যারিয়ারেরও স্বপ্ন নেই, নেম-ফেমেরও তোয়াক্কা করি না। সুলতান ভাইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণ তার বোহেমিয়ান লাইফ নয়। আমার জীবন সুলতান ভাইয়ের চেয়ে কম বোহেমিয়ান ছিল না। আজ দিনে খাবার আছে তো রাতে নেই। এখন এখানে আছি তো এই নেই, এভাবে কেটেছে। আমাদের বন্ধু-বান্ধবও ও রকম ছিল। সুলতান ভাইয়ের ওপর মুভি করার একটা কারণ ছিল আর তা হলো, তার সংস্পর্শে থাকা। নানা লোকোতসবে যেতাম। বিজয় সরকার তখন জীবিত, তার গানের অনুষ্ঠানে যেতাম। বিচিত্র সব লোকমেলায় যাওয়া হতো। গ্রামে বড় হয়েছি, কিন্তু গ্রামটাকে আমি অ্যাপৃশিয়েট করতে পারিনি গ্রামের ছেলে হিসেবে। দ্বিতীয়বার যখন সুলতানের চোখ দিয়ে গ্রাম দেখেছি তখন আমি প্রকৃত গ্রামবাংলাকে আবিষ্কার করেছি। মুভিটা হয়ে গিয়েছিল বাইপ্রডাক্ট।
মুভির শেষ পর্যায়ে ক্যাথরিনের সঙ্গে আমার পরিচয়। সুলতান মুভিটা হয়তো বোহেমিয়ানপনাতেই শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু তার সঙ্গে পরিচয়ের পর ওই ফিল্মটা শেষ করতে আমার ওপর তাগাদা ছিল। ও মুভির শেষ পর্যায়ে যুক্ত হলো। ও জানে না কিছু। কিন্তু আমার সম্পাদক অসুস্থ ছিলেন বলে ও বললো, দেখি না কি হয়। এভাবেই ও আমার মতো কচু গাছ কাটতে কাটতে ডাকাত হয়ে গেল। আরেকটা কাকতালীয় ঘটনায় আমার জীবনে ক্যাথরিনের আবির্ভাব। সেই কাকতালীয় ঘটনার অংশ হিসেবে আমেরিকায় যাওয়া। আমেরিকায় না গেলে লিয়ার লেভিনের সঙ্গে পরিচয় হতো না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশ ঘণ্টার ফুটেজ পাওয়াও যেতো না। আশির দশকে আমার বন্ধু তানভীর, মোরশেদ সবাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেছিলেন। আমি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করিনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমার আলাদা দুর্বলতা ছিল, তা-ও নয়। আমি কাকতালীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের মুভি নির্মাতা।
কিন্তু ব্যাপারটা তো ঘটে গেছে। আপনি একটি না, বেশ কয়েকটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মুভি বানিয়েছেন।
হ্যা, তা ঠিক। মাটির ময়না হয়তো প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধেরই মুভি। মুক্তিযুদ্ধ তো শুধু ওই নয় মাস নয়, এর পটভূমি ১৯৬৯, ১৯৭০ সালের। মুক্তির গান কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মুভি নয়, যুদ্ধের মুভি তো নয়ই। মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ। আমি কিন্তু এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের যে মূল বিষয় যুদ্ধ, তা নিয়ে কোনো মুভি বানাইনি। মুক্তির গান হচ্ছে যুদ্ধের সবচেয়ে প্রান্তিক বিষয়, অর্থাৎ বন্দুকের ধারে-কাছেও নয়। গান দিয়ে যুদ্ধ। যারা সাংস্কৃতিক কর্মী তাদের তো সবচেয়ে পেছনের ভূমিকা। এই আলোচিত ও অনালোকিত দিকটা আমি তুলে ধরেছি। মুক্তির কথা কি? মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্নভঙ্গ, সেটা নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ করে কি হলো, সেই যে তিক্ততা, বিটারনেস। আবার নারীর কথা, মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে। যাদের মুক্তিযুদ্ধে কোনো অংশগ্রহণ নেই বলে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত তাদের নিয়ে। অর্থাৎ আমরা সেন্ট্রাল বিষয়ের আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করেছি। সেটা কিন্তু অসচেতন নয়, সচেতন চেষ্টা।
অনেকে মাটির ময়নাকে ইসলাম বিষয়ক, মাদ্রাসা বিষয়ক মনে করে। মুভিটা শেষ হয়েছে নাইন-ইলেভেনের আগে। আমি জানতাম না নাইন-ইলেভেন হবে। নাইন-ইলেভেন না হলে এটা আন্তর্জাতিক কেন দেশীয় প্রাসঙ্গিকতা পেতো কি না সন্দেহ। কিন্তু হঠাৎ করে এটা নাইন-ইলেভেনের পর টপিকাল হয়ে গেল।
কেউ যদি খেয়াল করে তবে দেখবে, এটা নিজের শৈশবের সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়া। কামিং অফ এজ, সম্পর্ক নিয়ে সিনেমা। গ্রামবাংলার সংস্কৃতির প্রতি একটা টৃবিউট। উগ্রতা বনাম সহনশীলতার সম্পর্ক।
তেমনি অন্তর্যাত্রা, অনেকে বলে এটা প্রবাসীদের নিয়ে মুভি। যেহেতু এখন পর্যন্ত প্রবাসীদের নিয়ে কোনো মুভি হয়নি সেহেতু কেউ বলতে পারে। কিন্তু এটা প্রবাসীদের নিয়ে মুভি নয়। এটা এক ধরনের শেকড় সন্ধান, এক ধরনের আত্মপরিচয় খোজার ব্যাপার এবং সম্পর্ক নিয়ে তৈরি। মাটির ময়নার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু কোথাও হয়তো একটা গাঢ় সম্পর্ক আছে।
আমার মনে হয়েছে, এই প্রথম আপনি পুরোপুরি ফিচার ফিল্মের দিকে গেলেন। মাটির ময়না অটোবায়োগ্রাফিকাল বলে অনেকটা ডকুমেন্টারি। এর আগের মুভিগুলোও ডকুমেন্টারি। আদমসুরত থেকে মাটির ময়না পর্যন্ত আপনার কি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলিং হয়েছিল?
এক ধরনের আনলার্নিং হয়েছিল। ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ আছেন, জেমস লিহি আছেন। জেমস লিহি বৃটিশ। ফাদারের মধ্যে যেমন কানাডার কিছুই নেই, আমাদের থেকে অনেক বেশি তিনি দক্ষিণ এশিয়ান বা ইনডিয়ান তেমনি জেমস লিহির অস্থিমজ্জায় ছিল আফৃকান সিনেমা, ল্যাটিন আমেরিকান সিনেমা। তার একটা মাসব্যাপী কর্মশালা হয়েছিল ঢাকায়। সেটা আমার চোখ একদম খুলে দিয়েছিল। আমার সঙ্গে যারা ছিলেন সবারই কম-বেশি চোখ খুলে দিয়েছে। সিনেমা তাত্ত্বিকভাবে দেখা, রাজনৈতিকভাবে দেখা, শৈল্পিকভাবে দেখা, নৃতাত্ত্বিকভাবে দেখা এ মাল্টিপার্সপেক্টিভ, মাল্টিপ্লিসিটি ব্যাপারটার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। যেটার এখন চর্চা হচ্ছে সেটা আমরা ১৫-২০ বছর আগে জানার সুযোগ পেয়েছিলাম। এ ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ জাক লাঁকা বোঝালেন। সিনেমার সঙ্গে লাঁকার কি সম্পর্ক। আমি সৌভাগ্যবান নই? কোথায় একটা মাদ্রাসা পড়া গ্রামের ছেলে। এখানে ছোটখাটো মাদ্রাসায় আজান দেয়ার কথা অথবা মৌলবি হওয়ার কথা। যে দুর্ভাগা দেশে সিনেমার কোনো স্কুল নেই সে দেশে আমি সিনেমা বানাচ্ছি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পুনার স্কলারশিপও যোগাড় করেছিলাম কিন্তু এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর প্রথমেই সব ইনডিয়ান স্কলারশিপ বাতিল করে দিলেন। সঙ্গে আমারটাও গেল। সৌভাগ্যক্রমে আমি কলকাতায় গিয়ে ফাদার প্রতিষ্ঠিত সিনেমা শিক্ষা কেন্দ্রে চিত্রবাণীর এক মাসের কোর্স করেছি। ওখানে যারা এখন একাডেমিকভাবে সিনেমার বড় পন্ডিত তাদের সঙ্গে চিত্রবাণীতে কোর্স করার সুযোগ পেয়েছি।
এখন তো আমেরিকার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পুরোটাই কর্পরেট। এমন কি বৃটিশ কাউন্সিলও আংশিকভাবে কর্পরেট হয়ে গেছে। শিক্ষা ব্যবসা। কিন্তু তখন তারা নানা চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক পণ্ডিত আনতো। চিত্রকলা, কবিতা ইত্যাদি নিয়ে আমাদের ব্যাপক কর্মশালা করার সুযোগ হতো। কিন্তু এখনকার তরুণরা এগুলো থেকে বঞ্চিত। আশির দশক পর্যন্ত গ্যেটে ইন্সটিটিউট ক্ষীণভাবে হলেও চলচ্চিত্র শিক্ষা বা চোখ খুলে দেয়ার মতো কর্মশালাগুলোর আয়োজন করতো। এখন তাও করে না। নিবুনিবুভাবে আলিয়স ফ্রসেজ আছে। তাও খুব ক্ষীণ।
আপনার মুভি দেখে কিন্তু মনে হয় এর পেছনে দীর্ঘ একাডেমিক প্রস্তুতি আছে।
না, সে রকম কিছু ছিল না। কিন্তু আগ্রহটা ছিল। চলচ্চিত্রকে একাডেমিকভাবে শেখার, শিল্প-সাহিত্যকে একাডেমিকভাবে বোঝার একটা আগ্রহ ছিল। এখনকার তরুণরা পুরনো মুভি দেখার প্রয়োজনও বোধহয় অনুভব করে না। সময় কোথায়? কিন্তু আমরা তখন জনপ্রিয় মুভিও দেখতাম। আলমগীর কবির যখন আমাদের কোর্স নিতেন তখন ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট দেখতে বলতেন। ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ যখন শোলে নিয়ে বলতেন তখন আমরা ভাবতাম, এ কি, শোলে কেন? পরে দেখলাম, সত্যজিৎ রায়কে যখন জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, আপনি শিখেছেন কোথায়? তিনি বলেছেন, জন ফোর্ডের কাছে। পুরো কাউবয় সিনেমা! তিনি বলছেন, আমি ক্রাফটটা শিখেছি ওখান থেকে। ক্রাফটটা তো বড় জিনিস। পরিচালনা তো কেউ শেখাতে পারবে না। তিনি ১৯৪৮ সালে একটা লেখা লিখেছিলেন, মুভি বানানোর প্রায় চার-পাচ বছর আগে। নাম হোয়াট ইজ রং উইথ ইনডিয়ান সিনেমা। ওখানে তিনি মেলোড্রামাটিক অভিনয়, জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন সিনেমার কথা নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেই প্রত্যয় থেকেই তিনি পথের পাঁচালী তৈরি করলেন। পথের পাঁচালী থেকে বাংলাদেশ তো দূরের কথা পশ্চিমবঙ্গের সত্যজিত পরবর্তী নির্মাতারাও সেই রিয়েলিটি থেকে শিখতে পারেননি। অপেশাদার শিল্পীর কাছ থেকে কি অসাধারণ ন্যাচারাল অভিনয় আদায় করেছেন।
বিশাল প্রদীপের কাছ থেকে নিজেকে আলোকিত করার যে সুযোগ পেয়েছি সেটা কিন্তু এক ধরনের সৌভাগ্য। সচেতনভাবে যদি চাইতাম ‘আমি শিখবো’, তাহলে হতো না। সুলতান ভাইয়ের সঙ্গে সময় অপচয় করে শিখেছি। ওয়ার্কশপগুলো করেছি। এগুলো সবই কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এগুলো কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নয় যে, কালকে টেলিভিশনে নাটক বানাবো বা সিনেমার ডিরেক্টর হবো। মুভি নির্মাণের প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে হঠাত আবিষ্কার করেছি যে, আমার নেশাটা পেশা হয়ে গেছে। কখনোই ভাবিনি নির্মাতা হবো। বিনয় করে বলছি বলে নয়। এটা এ কারণে যে, চাকরি আমার দ্বারা হবে না, এটা অনেক আগেই বুঝে গিয়েছি, ব্যবসা হবে না বুঝে গিয়েছি। আমার দক্ষতা বা ক্ষমতা কোথায় আমি কখনোই বুঝতে পারিনি। কালকেও যদি আয়-রোজগার ও শান্তি পাওয়ার মতো কাজ পেয়ে যাই তবে সিনেমাকে আজই ত্যাগ করতে রাজি আছি। এটা খুবই একটা এক্সট্রোভার্ট মাধ্যম। এর প্রধান প্রক্রিয়াটা নাথিং কৃয়েটিভ, খুবই প্রোজেইক। মুভির চিত্রনাট্যের সময় আমি একটু আনন্দ পাই আর মুভির শেষ পর্যায়ে সম্পাদনার শেষে গিয়ে একটা কৃয়েটিভ আনন্দ পাই। কিন্তু মাঝখানেরটা একটা আর্মি রান করানোর মতো কাজ। অনেকে এনজয় করে সেটা। আমি এনজয় করি না। ক্রাউড হ্যান্ডল করা, ম্যানেজমেন্ট, অর্থ ম্যানেজমেন্ট সবকিছু মিলিয়ে। আর শুটিংয়ের সময় আমি যে আমিকে পাই সে আমি না। আমার সঙ্গে যারা কাজ করে তারা জানে আমি খুব আনপ্লেজেন্ট মানুষ। আমি ডিমান্ডিং। আমি জানি, আমি যদি এখন ভালো মানুষের মতো, ‘না না ঠিক আছে, কিছু হবে না, অসুবিধা নাই, এখন করো নাই পরে হবে,’ বলি তাহলে হবে না। আই অ্যাম রেডি টু বৃং হেল টু মাই কাস্টস অ্যান্ড ক্রুজ। আমি যদি এখন তাদের কাছে জনপ্রিয় ও ভালো মানুষ হতে চাই তবে হয়তো জনপ্রিয়ই হবো কিন্তু পরে তো আমি এটা সম্পাদনার টেবিলে মেরামত করতে পারবো না। ফলে আই বিকাম ভেরি ডিমান্ডিং। আর এ প্রক্রিয়ায় আমি খুব আগলি পারসনে পরিণত হই। এটা আমি পছন্দ করি না। ওটা আমি নই।
আপনার পরের মুভি কি নিয়ে?
কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করে আপনার পরের মুভি কবে শুরু হচ্ছে তখন হাসি। মানুষ মুভি নির্মাণ বলতে মনে করে শুটিংটা। কিন্তু আমি মনে করি প্রস্তুতির বাস্তবায়ন হয় শুটিংয়ের মাধ্যমে।
গত তিন বছর যে মুভিটা নিয়ে প্রধানত কাজ করছি সেটা ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের প্রেক্ষাপটে বড় আয়োজনের বড় আয়তনের একটি কাহিনী। যেটা বাজেটে মাটির ময়নাকে ১৪ গুণ ছাড়িয়ে যাবে। এই সিনেমার প্রস্তুতির ফাকে কিন্তু অন্তর্বর্তী কাজ হিসেবে অন্তর্যাত্রা তৈরি হলো।
এর কাহিনী কি আপনারই?
সব মুভির ভেতরই যেমন আমাদের কিছু অভিজ্ঞতা থাকে এটাতেও তেমনি থাকবে। অভিজ্ঞতার বাইরে যাই না আমি। অন্তর্যাত্রাও কিন্তু আমাদের নিজেদের যাত্রা। যদিও এটা ১৯৪৭-এর কিন্তু এক অর্থে মাটির ময়নার সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে। এটা একটা পৃকুয়াল। এই যে কাজী আমার বাবা, তার তরুণ বয়সের ফায়ারব্রান্ড, র্যাডিকাল অবস্থা নিয়ে। ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতায় ছিলেন। এই তরুণ কাজীর গল্প।
নাম ঠিক হয়েছে?
হয়েছে। কিন্তু বলবো না। ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগটা এক বিচিত্র কারণে ওভারশ্যাডোড। ১৯৭১ আমাদের আচ্ছন্ন করেছে বলে ১৯৪৭ নিয়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি। কিন্তু এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। কিন্তু ১৯৪৭ খুবই কানেকটেড। এমন কি আজকের বাংলাদেশের সঙ্গেও কানেকটেড। এ মুভিটি তৈরি হলে মাটির ময়না মুভিটি সিকোয়েল হয়ে যাবে। মাটির ময়না মুভিটি বুঝতে সুবিধা হবে। এই যে আমরা খণ্ড খণ্ডভাবে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন সময় তুলে ধরি হিউম্যান স্টোরির ব্যাকড্রপ হিসেবে তার মধ্যে কিন্তু অখ- প্রয়াস আছে আমাদের। যদি বেচে থাকি তবে আমার ইচ্ছা আছে আর্লি ইস্ট ইনডিয়া কম্পানির দিকে ফিরে যাওয়ার। ফাউন্ডেশন অফ ইস্ট ইনডিয়া কম্পানি। যেটা আজকের বিশ্বে খুবই প্রাসঙ্গিক। গ্লোবালাইজেশন, ইউনিপোলার ওয়ার্ল্ড হচ্ছে, মার্কেটভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠছে।
১৯৪৭ সালের মুভিটাই শেষ করতে পারবো কি না জানি না। এ বছরের আগস্টে শুটিং শুরু হবে আশা করছি। স্কৃপ্ট রেডি। তিন বছর লেগেছে, রিসার্চ হয়েছে প্রচুর। কলকাতাসহ অনেক জায়গায় শুটিং হবে। আয়োজনে এটা একসঙ্গে ইনডিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে রিলিজ করার ইচ্ছা আছে।
যতোদূর বুঝতে পেরেছি আপনার স্কুলিংটা সত্যজিত রায় ঘরানার? অন্তর্যাত্রা দেখে এটা আমার আরো বেশি মনে হয়েছে।
ভেরি মাচ। কেন মাটির ময়নাও তো। মাটির ময়নার যে স্ট্রাকচারটা, তাতে এক ধরনের ফুয়িডিটি আছে কিন্তু সেটা সত্যজিৎ রায়ের মুভির মধ্যেও থাকে। তার ব্যাকগ্রাউন্ড গ্রাফিক আর্ট। ওই গ্রাফিক কমপ্যাক্টনেস আছে তার মুভির মধ্যে। খুব স্ট্রাকচারড, ভেরি স্লো পেসড একদম মেজারড। আমি মেজারমেন্ট ছাড়া মুভি করি না। আমি ঋত্বিকে মতো রাগেড মুভি করি না, ওটারও গ্রাফিক বিউটি আছে। আমি ওটাকে ছোট-বড় করবো না। আমার মুভিতে এ পর্যন্ত রাগেডনেসের দিকে নয়, সিমপ্লিসিটির দিকে গিয়েছি। কোনো জায়গায় যেন চটক, কোনো জায়গায় যেন গিমিক, কোনো জায়গায় যেন একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এটা আমি অ্যাভয়েড করি। কিন্তু আমার রুচির যারা উল্টো মুভি করে আমি তাদের সবচেয়ে পছন্দ করি। অনেকে আমাকে বলে, আপনি কেন লিখে, বলে ফারুকির মুভির প্রশংসা করেন। আমি ঠিক ওই টেমপারামেন্টের নই। কিন্তু সবাই আমার মতো হবে কেন। হোয়াই নট উই সেলিব্রেট ডাইভারসিটি? এই জিনিসটাকে আমি চলচ্চিত্র সংস্কৃতিতে প্রয়োজনীয় মনে করি। আমাদের টলারেন্স বাড়াতে হবে। আমি সত্যজিতের মতো মুভি বানাবো কিন্তু ঋত্বিককে আমি ফেলে দেবো কেন?
সত্যজিৎ রায় ছাড়া আপনার স্কুলিংয়ের ভেতর আর কোন কোন ডিরেক্টরকে আপনি অন্তর্ভুক্ত করতে চান?
আমার শৈশবের কারণেই হোক আর যে কারণেই হোক, আমাকে ধর্মের সঙ্গে ডিল করতে হয়েছে। শৈশবে আমি এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। তরুণ বয়সে নিজের মধ্যে অ্যান্টিরিলিজিয়াস রিঅ্যাকশন হয়েছে। বাই দি টাইম আমি যখন মাটির ময়না মুভি করলাম তখন আমি দেশের বাইরে। আমি যখন ক্যাথরিনকে এ গল্প বললাম তখন সে বললো এটা নিয়ে মুভি করো। আমার মধ্যে যে ভাবনাটা এলো সেটা কিন্তু দেশ থেকে দূরে থাকার কারণে পাওয়া একটা বাড়তি পার্সপেক্টিভ। দূর থেকে যখন দেখলাম তখন বুঝলাম যে সবকিছুই তো রিঅ্যাক্টিভভাবে দেখা ঠিক নয়। এটাকে নির্মোহভাবে নৃতাত্ত্বিকভাবেও তো দেখা যায়। ধর্মটাকে যদি আমি সংস্কৃতি হিসেবে, ওই সময়ের একটা পারিপার্শ্বিকতা হিসেবে দেখি, চলচ্চিত্রের ম্যাটারিয়াল হিসেবে দেখি, তখন ধর্মকে একহাত দেখে নিতে হবে, এ চলচ্চিত্রের মানসিকতা আর ওইভাবে কাজ করে না। আপনি যদি আবার মুভিটা দেখেন তবে বুঝতে পারবেন এই নাইন-ইলেভেন না হলে সেকুলারিস্টরা এটাকে প্রোইসলামিক মুভি হিসেবে চিহ্নিত করতো।
আব্বাস কিরোস্তামির প্রভাব আমার ওপর আছে, তার সিমপ্লিসিটির কারণে। যেসব চলচ্চিত্রকারের ছোটবেলা ধর্মের মধ্য দিয়ে কেটেছে এবং যারা ধর্ম সংশ্লিষ্ট শৈশবকে মুভির কাজে লাগিয়েছে তাদের মুভির সঙ্গে আমি নিজেকে রিলেট করতে পারি। বার্গম্যান, বুনুয়েল, কার্ল ড্রায়ার, ওজু, ব্রেসো। আমার এখনকার অবস্থান হলো, আমি ধর্ম বিরোধী নই। ধর্মাসক্তও নই। কিন্তু আমি এক্সটৃমলি ইন্টারেস্টেড ইন রিলিজিয়ন।
Thursday, April 19, 2007
আনবিয়ারএবল লাইটনেস অব বিইং (১৯৮৮)
প্রথমবার কোনো ম্যানসাইজ স্ক্রিনে কোনো সিনেমা দেখার পর সেটা ছোট কম্পিউটার স্ক্রিনে রিভাউজ দেয়া খুব কষ্টকর এক অভিজ্ঞতা। কিন্তু কি করবো নতুন করে না দেখলে পুরনো ইমেজগুলো ঝালাই করে নতুন করে বোঝাও সম্ভব হয় না। তাই ছোট স্ক্রিনেই আবার দেখলাম আনবিয়ারএবল লাইটনেস অব বিইং। বাংলায় কী হবে? অস্তিত্বের অসহনীয় লঘুভার। এই নামের ভেতরেই আছে আরেক উপনাম : অস্তিত্বের অসহনীয় গুরুভার। মিলান কুন্ডেরা আমার প্রিয় লেখক। পলিটিক্স ও সেক্সের সমন্বয় খুব কম লেখকের মধ্যেই আছে। আর এক্ষেত্রে কুন্ডেরা হলেন মাস্টার। সঙ্গে আছে সেক্সুয়াল পলিটিক্স। পূর্ব ইউরোপের রাজনীতি, চেকোশ্লাভাকিয়া আরও কত বিষয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় কুন্ডেরার এই উপন্যাসটি আমার পড়া হয়নি। ২০০১ বা ১৯৯৯ তে জহির রায়হান ফিল্ম সোসাইটির উদ্যোগে গ্যাটে ইন্সটিটিউটে একটা শো হয়েছিল নভেল টু ফিল্ম শিরোনামে। তখন আনবিয়ারএবল দেখেছিলাম। মার্কেজের সরলা এরন্দিরা, গুন্টার গ্রাসের টিন ড্রাম, উমবার্তো একোর নেম অব দ্য রোজ সহ বেশ কয়েকটি দারুণ মুভি তখন দেখা হয়েছিল।
দিন তিনেক আগে আনবিয়ারএবল হাতের কাছে পেয়ে একটু দ্বিধায় ছিলাম আবার দেখবো কি না এই ভেবে। শেষ পর্যন্ত দেখলাম। ১৯৯৯ বা ২০০১ এ যে আনবিয়ারএবল-এর কাহিনী একটু অচেনা, একটু দূরের ব্যাপার ছিল তা ২০০৭ এ এসে একান্ত নিজের হয়ে গেছে। জীবনের অসহনীয় লঘুভার প্রকান্তরে আমাদের আক্রান্ত করেই ফেলেছে। এই উপলদ্ধি বেশ ভাবাচ্ছে।
আন্না কারেনিনা নিয়ে ভাবছিলাম কিছুদিন ধরে। মিরাকল হলো, এই সিনেমায় প্রথম যখন নায়ক টমাসের সঙ্গে টেরেজার দেখা হয় তখন তার হাতে ছিল আন্না কারেনিনা। আর কালক্রমে টমাস টেরেজার কুকুরের নাম রাখা হয় কারেনিন। টমাস অবশ্য কুকুরের নাম তলস্তয় রাখার প্রস্তাব রেখেছিল। কিন্তু কুকুরটা শি ডগ বলে কারেনিনা রাখার সিদ্ধান্ত হয়। আর দেখতে পুরুষ মতো বলে এর নাম দেয়া হয় কারেনিন। কুন্ডেরার এই নাম রাখার প্রস্তাব কো-ইন্সডেন্স নয়। সোভিয়েট রাশিয়া তার দেশে যে আগ্রাসন চালিয়েছিল তার অভিজ্ঞতা তাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। দস্তয়েভস্কির প্রতি তার বিরাগের কথা সকলের জানা। কারণ সোভিয়েত আগ্রাসনের দুঃসহ দিনগুলোতে ইডিয়টের নাট্যরূপ দিয়ে তাকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছিল। আনবিয়ারএবল-এ আছে তলস্তয়ের প্রতি টমাস-টেরেজার প্রচুর ভালোবাসা।
এ সিনেমার আরেকটি সেন্ট্রাল থিম ইডিপাক্স রেক্স।
কাহিনী ১৯৬৮ সালের প্রাগের। এখানকার ডাক্তার টমাস একজন উইমেনাইজার। একে প্রায় দর্শনের পর্যায়ে বিবেচনা করে সে। একের পর এক বান্ধবীর সঙ্গে চলতে থাকে তার সেক্সুয়াল সম্পর্ক। সে লাইটনেসকেই জীবনের অবলম্বন হিসাবে বেছে নিয়েছে। এই যৌনতা তার কাছে ফুটবল খেলার মতো। কিন্তু প্রাগ অধিকৃত হবার পর জেনেভা গিয়ে টামাস ও টেরেজার মধ্যে এই লাইটনেস নিয়ে সংঘর্ষ বাধে। টেরেজা অনুভব করে তার পক্ষে এই লাইটনেস ও স্ট্রংনেসের জীবন বেছে নেয়া সম্ভব নয়। ফলে সে ফিরে আসে সেই প্রাগে। তার পেছন পেছন আসে টমাস। নিগ্রহ নিপীড়নের এক জীবন হয় তাদের। যেখানে টেরেজা তীষণ আক্রান্ত বোধ করে। শেষ পর্যন্ত তারা চলে যায় গ্রামে। এক বন্ধুর কাছে।
এই সিনেমা এত ডিটেইল যে বিশেষ ছোট বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। কুন্ডেরা অনেক প্রতীক ও সংকেত নিয়ে কাজ করেন। প্রতিটি কথা প্রতিটি দৃশ্য গভীর অর্থজ্ঞাপক। আশার কথা সিনেমার ডিরেক্টর ফিলিপ কফম্যান ব্যাপারগুলো যথাসম্ভব চিত্রায়িত করেছেন। ফলে, সিনেমাটি দেখার বা উপন্যাসটি পড়ার সত্যিই কোনো বিকল্প নেই।
Thursday, April 5, 2007
ফাদার গাস্তঁ রোবের্জের সাক্ষাতকার
ফাদার গাস্তঁ রোবের্জের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ মে। তিনি বিএ ডিগ্রি নেন ১৯৬৫ সালে। যোগ দেন সোসাইটি অফ জেসাস-এ (জেসুইট ফাদারস)। তার অনুরোধেই তাকে ইনডিয়ায় পাঠানো হয় ১৯৬১ সালে। তখন থেকেই প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে তিনি কলকাতায় বাস করছেন। ১৯৬৯-৭০ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে থিয়েটার আর্টসে (ফিল্ম) এমএ ডিগ্রি নেন। ১৯৭০ সালে সত্যজিত রায়ের সহযোগিতায় কলকাতায় চিত্রবাণী নামে একটি কমিউনিকেশন সেন্টার স্থাপন করেন। ১৯৮৬ সালে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে এডুকেশনাল মিডিয়া রিসার্চ সেন্টার চালু করেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে তিনি ফিল্ম বিষয়ক শিক্ষাদানের সঙ্গে জড়িত। শিক্ষাদানের পাশাপাশি তিনি ফিল্ম বিষয়ে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। তার বইগুলোর মধ্যে চিত্রবাণী, সিনেমার কথা, নতুন সিনেমার সন্ধানে, সংযোগ সিনেমা উন্নয়ন, আইজেনস্টাইনস আইভান দি টেরিবল : অ্যান এনালাইসিস, এনাদার সিনেমা ফর এনাদার সোসাইটি, দি সাবজেক্ট অফ সিনেমা, সাইবারবাণী ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখন ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ বাংলাদেশে অবস্থান করছেন ‘ওয়ার্কশপ অন মুভিজ টুডে’ শিরোনামের একটি কর্মশালা পরিচালনার কাজে। এটি আয়োজন করেছে একাডেমি অফ ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া ও প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র। এ কাজের অবসরে গাস্তঁ রোবের্জ কথা বলেছেন যায়যায়দিনের সঙ্গে। সাক্ষাতকার নিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ। উপস্থিত ছিলেন হাসান বিপুল ও বিবেশ রায়। ফাদারের ছবি তুলেছেন হাসান বিপুল।
প্রশ্ন : বাংলা কিভাবে শিখলেন?
উত্তর : আমি যখন কলকাতায় আছি তখন বাংলা শিখবো না! আমি তো কলকাতায় অনেক দিন ধরে আছি, এটা জানো? ১৯৬১ থেকে। অর্থাৎ ৪৫ বছর। প্রথম দিন থেকে আমি বাংলা শিখতে শুরু করেছি। আমাকে এখানে বলা হয়েছে আরো ভালো বলা উচিত। আমি সিনেমা সম্পর্কে কথা বলতে অনেক দিন ধরে ঢাকা আসি। রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির আমন্ত্রণে আমি একবার গ্যেটে ইন্সটিটিউটে এসেছিলাম। তখন একজন বললো, আরো ভালো বাংলা বলা উচিত। আমি মনে করি কথাটা ঠিকই বলেছে। কলকাতায় শতকে ৪৯ মানুষ বাংলাভাষী। প্রায় অর্ধেক মানুষ বাংলায় কথা বলে। বাকিরা হয় হিন্দি নয় ইংরেজি ভাষায় কথা বলে। বাকি জায়গায় পুরোপুরি বাংলা। সাওতালি আছে, অন্য ভাষা আছে। বেশির ভাগই বাঙালি কিন্তু কলকাতা আলাদা। দেখা যায় যখন ঢাকায় আসি তখন এখানে সবাই বাংলায় কথা বলে।
প্রশ্ন : সাধারণত আমাদের এখানকার মানুষ ওয়েস্টের জন্য আকুল হয়ে থাকে। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে দেখা গেল উল্টো ঘটনা - আপনি ওয়েস্ট থেকে এসে বাংলায় থাকতে শুরু করলেন। আপনি কেন বাংলায় থেকে গেলেন? কি এমন আকর্ষণ বাংলার।
উত্তর : খুবই ভালো প্রশ্ন। আশা করি একটা ভালো উত্তরও আছে। আমি যখন একেবারে পাচ বছর বয়সী তখন আমার একজন মামা ইনডিয়াতে এসেছিলেন। তিনি কানাডিয়ান আর্মিতে ছিলেন। কানাডিয়ান আর্মিতে কাজ করতেন। তিনি আসলে সিলনে ছিলেন। তখনকার সিলন আজকার শ্রী লংকা। সিলন তখন ইনডিয়ার একটি অংশ ছিল। ইনডিয়াতেই ছিলেন তিনি। আমি মাঝে মধ্যে মামার কাছে যেতাম। তিনি আমাকে ইনডিয়ার গল্প বলেছিলেন। তিনি বলতেন, ‘ভারত না ভারতীয়। দেশ না মানুষ।’ এই ব্যাপারটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। যখন কলকাতা পৌছলাম তখন তার কথা মনে হয়েছিল। তিনি যেন একটা বীজ রোপণ করেছিলেন আমার প্রাণে। দু নাম্বার ব্যাপার হলো, আমি যখন কানাডা থেকে কলকাতা আসি। আমার বড় ফাদার বলেছিলেন, তুমি যাও নৌকা করে। জাহাজে। আস্তে আস্তে যাবে। মনে শান্তি পাবে। আমি মন্টৃয়ল থেকে নিউ ইয়র্ক গেলাম এক রাত্রির জন্য। আমার জাহাজটা নিউ ইয়র্ক থেকে ছেড়ে দিয়েছে। যেতে যেতে শুনলাম, যেখানে যাচ্ছি সেই কলকাতা থেকে একটা টৃলজি দেখানো হয়। সত্যজিৎ রায়ের অপু টৃলজি। এক রাতে আমি অপু টৃলজি দেখলাম। অসাধারণ! কি সুন্দর, কি মানুষ। যখন কলকাতা পৌছলাম তখন আমার মনে হলো, এই তো সর্বজয়া, হরিহর, দুর্গা, অপু। ফলে সম্পর্ক হয়েছে প্রাণের সম্পর্ক। আমার মামা যে বলেছিলেন তা কুড়ি বছর পরের ঘটনা ছিল এটা। আমি তো ইনডিয়া, পশ্চিমবঙ্গ, কলকাতা সম্পর্কে কিছু জানতাম না। কিন্তু এটা ছিল হার্ট অফ বেঙ্গলের দিকে আমার যাত্রার শুরু।
প্রশ্ন : মানুষের কথা তো শুনলাম। এখানকার ইন্টেলেকচুয়ালিটি আপনাকে কি আকৃষ্ট করেছে? ইনডিয়ান চিন্তা বা বাংলার চিন্তা আপনাকে আকৃষ্ট করেছে কি? সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আপনার সখ্যের কথা আমরা জানি। তার বাইরে ইনডিয়ান থট প্রসেস, নন্দনতত্ত্ব আপনাকে আকৃষ্ট করেছে কি না।
উত্তর : আমি আস্তে আস্তে আকৃষ্ট হয়েছি। সর্বপ্রথম আমি ইয়োগা শিখলাম একজন ইনডিয়ান সাধুর কাছ থেকে। তারপর মির্চা এলিয়াদের বই থেকে ইয়োগা সম্পর্কে পড়লাম। তারপর এলো রবীন্দ্রনাথ। গীতাঞ্জলি। আমি একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম ডায়ালগ উইথ টেগোর। কাল্পনিক একটা ডায়ালগ। যেখানে টেগোর আমাকে বলছেন, তোমরা ওয়েস্টের লোকরা দমন করতে চাও পৃথিবী ও জীবন। কিন্তু আমরা এনজয় করতে চাই। গভীরভাবে এনজয় করতে চাই। উই ওয়ান্ট টু লিভ ফুলি। এটা ছিল তখন আমার মতো।
আমি রোমে আমার বড় ফাদারকে বলেছিলাম, আমি সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করতে চাই। তিনি আমাকে কলকাতায় যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমি শিখতে চেয়েছিলাম এখানকার সংস্কৃতি ও ধর্ম। বিশেষভাবে ধর্ম শিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সময়ক্রমে আমি মুসলিম ধর্মের চেয়ে হিন্দু ধর্মের দিকে ঝুকে পড়েছিলাম। নিশ্চয় আমাকে আমার সংস্কৃতি বা ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে আমি উত্তর দেবো। কিন্তু প্রচার করা আমার প্রধান উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষা গ্রহণ করা। সময়ক্রমে আমি যখন ফাদার হয়েছি তখন আমার বড় ফাদার বললেন, তুমি কমিউনিকেশন লাইনে কাজ করো। আসলে আমি শুরু থেকেই কমিউনিকেশন করছিলাম। ডায়ালগ করছিলাম। ডায়ালগ তো এক ধরনের কমিউনিকেশন। তখন আমি আবার ফিরে গিয়েছি ইউনাইটেড স্টেটসে। কারণ তখন ইনডিয়ান তিন বছর ছাড়া সিনেমা সম্পর্কে কোর্স ছিল না। ওখানে গিয়ে আমি এক বছরের মধ্যে কোর্স করেছি। এর আগে অনেক পড়েছি। এ কারণে এক বছরের মধ্যে কোর্স করতে সুবিধা হয়েছে।
আমাদের ধর্মে প্রচার একটা বড় ইমপালস। কিন্তু আমি বেছে নিয়েছি কমিউনিকেশন। আমি জানি, শুধু প্রচার করলে কমিউনিকেশন হয় না। প্রথমে শুনতে হয়, শিখতে হয়। নইলে ডায়ালগ হয় না।
প্রশ্ন : কলকাতায় আপনার কাজের শুরুটা কিভাবে হয়েছিল?
উত্তর : শুরু থেকে আমার উদ্দেশ্য ছিল মিডিয়া এডুকেশন। যেহেতু চলচ্চিত্র একটা শক্তিশালী ও জনপ্রিয় আর্ট মাধ্যম সেহেতু শুরুতে আমার উদ্দেশ্য ছিল সিনেমার মাধ্যমে সব মিডিয়ার কাছে পৌছানো। এটা শুধু সিনেমা নয়, সিনেমার মাধ্যমে মিডিয়া, মিডিয়ার মাধ্যমে সমাজের কাছে পৌছানো। সমাজ হলো আসল কথা। কিভাবে সমাজের মধ্যে একটি অর্থপূর্ণ জীবন তৈরি করা যায়। সিনেমা ইজ এ গুড এন্টৃ। সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। প্রথমে শুরু করেছি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। তারপর বুঝলাম একটা কাজ করার জন্য এমন একটা প্রতিষ্ঠান দরকার যে শুধু সেই কাজ করে। সেই প্রতিষ্ঠানের নাম হলো ‘চিত্রবাণী’। এটা আমরা শুরু করেছি ১৯৭০ সালের দিকে। এমন নয় যে এক বছরেই এটি গড়ে উঠেছে বরং ধীরে ধীরে এটি তৈরি হয়েছে। আমার সৌভাগ্য যে শুরু থেকে সত্যজিত রায় এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন এর ফাউন্ডার মেম্বারদের একজন। তিনি আলাপ-আলোচনা করে আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। যদিও তিনি ব্যস্ততার কারণে ওখানে খুব বেশি যেতেন না। অন্য একজন ফাউন্ডার ছিলেন কবিতা সরকার। এটা ছিল তার পেন নেম। তিনি ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের ভাইয়ের বউ। তিনিও খুব সাহায্য করেছেন।
প্রশ্ন : সত্যজিতের সঙ্গে আপনার পরিচয় কিভাবে হলো?
উত্তর : পরিচয় হয়েছে অপু টৃলজির মাধ্যমে।
প্রশ্ন : ব্যক্তিগত পরিচয়?
উত্তর : আমি কলকাতায় এসে অন্য ফাদার ও বন্ধুদের সঙ্গে অপু টৃলজি নিয়ে আলাপ করেছি। তখন তারা আমাকে বললেন, আপনি সত্যজিত রায়ের সঙ্গে দেখা করেন না কেন? তিনি খুব ভালো মানুষ। আমি বলেছি না। আমি যখন ওনার সব মুভি দেখিনি তখন ওনাকে গিয়ে কি বলবো? আপনার বয়স কতো? কতো সালে জন্ম, এইসব? এভাবে আমি আলোচনা করতে পারবো না। হলো কি, আমি যখন ১৯৭০ সালে এমএ করার পর ফিরে আসি তখন লন্ডনে যাই বন্ধু মারি সিটনের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি আমাকে একটা চিঠি দিলেন সত্যজিত রায়কে দেয়ার জন্য। মারি সিটন প্রথম আইজেনস্টাইন সম্পর্কে বায়োগ্রাফি লিখেছেন। তিনি আমাকে বললেন, তুমি মানিকদার কাছে একটা চিঠি নিয়ে যাও। তখন আমাকে যেতে হলো। সেদিন থেকে পরিচয় কিন্তু আমি আরো বেশি অপেক্ষা করতাম। আমি ভাবতাম আরো যোগ্যতা অর্জন করে তার কাছে যাবো। কিন্তু তারপরও আমাদের সম্পর্ক অনেক ভালো হয়েছে। কোনো দিন অসুবিধা হয়নি।
প্রশ্ন : সত্যজিতের সঙ্গে আপনার কাজের সম্পর্ক কিভাবে এগুলো?
উত্তর : আমাদের আলোচনার বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট মেনু ছিল না। যা মনে ছিল তা-ই আলোচনা হতো। মাঝে মধ্যে চিত্রবাণীর কাজ। মাঝে মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে যা ঘটছে তা। আলাপে বিশেষ কিছু ছিল না। সাধারণ আলোচনায় যা ঘটে তাই। একবার তিনি বললেন, আমি একটা নতুন ছবি করেছি প্রতিদ্বন্দ্বী। চলুন দেখি। রিলিজ হওয়ার আগে তিনি দেখতে চান কেমন মুভি, সাউন্ড এসেছে। হলে আমরা শুধু দুজন। তিনি ছিলেন আমার সাত আট ফিট দূরে। হঠাত একটা দৃশ্যে আমার মজা লেগেছে, তো আমি হাসলাম। সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম তার কোনো মজা ছিল না। আমার এতো লজ্জা হয়েছে! কিন্তু হাসি তো লুকানো যায় না।
প্রশ্ন : ব্যক্তি সত্যজিতের কোন ব্যাপারটা আপনাকে আকৃষ্ট করেছে?
উত্তর : এ রকম অনেক কথা আছে। একটা কথা বলবো। আমি তার কাছে রবিবার যেতাম ৯টার সময়। আমি জানতাম তখন তিনি ফৃ আছেন। কারণ এ সময় বেশি লোক বের হয় না। অসুবিধা হবে না। তিনি সব সময় প্রস্তুত। কিন্তু যখন শেষের দিকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন লাস্ট টৃলজি (গণশত্রু, শাখা-প্রশাখা, আগন্তুক) করার পর, সবাই বুঝতে পারলো তিনি আর বেশি দিন বাচবেন না। তখন আমার অভ্যাস মতো ৯টার সময় হসপিটালে গেলাম। তিনি ছিলেন ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে। ডাক্তার ঢুকতে দেবেন কি না এটা ভাবতে ভাবতে অনুমতি দিলেন। তার শরীর অসুস্থ, কিন্তু মন পরিষ্কার। আমি ঢুকতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছেন? ফিরে আসার সময় তিনি বাংলায় বললেন, খুব ভালো লাগলো। ওটা আমার সঙ্গে তার শেষ কথা। তিনি সব সময় ইংরেজিতে কথা বলতেন। খুবই ভালো ইংরেজি বলতে পারতেন। কিন্তু যখনই কোনো ইমোশনাল ব্যাপার আসতো, তিনি বাংলায় বলতেন। এ কারণেই তার শেষ কথাটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল। আমি কিছু বলিনি।
প্রশ্ন : আপনার মধ্যে কৃশ্চিয়ান অ্যাপ্রোচের সঙ্গে সর্বসাম্প্রতিক দর্শনের একটা ঐক্য দেখতে পাই। এটা কিভাবে সম্ভব হলো? এটা তো খুব কঠিন একটা কাজ।
উত্তর : কঠিন আছে। কিন্তু অসম্ভব নয়। আমরা সামাজিক স্বাধীনতা না পেতে পারি কিন্তু যদি ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীন হয়ে যাই তবে সেটা সম্ভব। সমাজের ভেতরে স্বাধীনতা আনার জন্য স্বাধীন মানুষ দরকার। মনের স্বাধীনতা, প্রাণের স্বাধীনতা কেউ কেড়ে নিতে পারে না। আমাকে হত্যা করতে পারে কিন্তু আমার স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে না।
প্রশ্ন : আপনার কি মনে হয় ব্যক্তির স্বাধীনতা সার্বিক স্বাধীনতা আনতে পারে। রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও আমরা পড়েছি ব্যক্তির মুক্তির কথা। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, ব্যক্তির মুক্তি কি সামষ্টিক মুক্তি আনতে পারে?উত্তর : এক সময় আমি এক সন্ন্যাসীকে ঠিক এই কথা বলেছিলাম। আমার যদি ঠিকঠাক মনে পড়ে তো তিনি বলেছিলেন, ইচ্ছা করতে হয়। আর এক রকম বিশ্বাস করতে হয়। এটা ধর্ম বিশ্বাস নয়, আস্থা বা নিশ্চয়তা তৈরি হতে হয়।
প্রশ্ন : আপনার বইয়ের প্রসঙ্গে আসি। আপনি কি ইংরেজি ভাষায় লেখেন?উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : শুনেছি এগুলো কবি উতপল কুমার বসু অনুবাদ করেছেন।উত্তর : সবগুলো না। সিনেমার কথা বইটা তিনি অনুবাদ করেছিলেন। আরেকটা বই সংযোগ সিনেমা উন্নয়ন বইটা অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের একজন লোক। তার নাম কৃষ্ণপদ শা-িল্য। এখন তিনি আমার নতুন একটি বই অনুবাদের কাজ করছেন। আমার প্রথম বই ছিল চিত্রবাণী। প্রতিষ্ঠান চিত্রবাণী ও প্রথম বই চিত্রবাণী নামটা আমি নিয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথ থেকে। আমি জানতাম সিনেমার বাংলা হিসেবে চিত্রবাণী শব্দটা তিনি বেছে নিয়েছিলেন। সেই চিত্রবাণী শব্দটা ৩৫ বছর পর এসে সাইবারবাণীতে পরিণত হয়েছে। আমার নতুন বই সাইবারবাণী।
প্রশ্ন : এখন কি নিয়ে কাজ করছেন?উত্তর : আরেকটা বইয়ের কাজ চলছে সত্যজিত রায়কে নিয়ে। বিভিন্ন সময়ে তার ওপর লেখা আমার প্রবন্ধগুলো সত্যজিত রায় : এসেজ ১৯৭০-২০০৫ নামে বের হবে দিল্লির মনোহার পাবলিকেশন থেকে। আরেকটা বইয়ের কাজ আমি করছি, নাম : প্যাডাগজি অফ দি মিডিয়া অবপ্রেসড। আমি এ নামটা নিয়েছি পাওলো ফ্রেরির একটা বইয়ের নাম থেকে। বইটার নাম প্যাডাগজি অফ দি অবপ্রেসড। এটা ল্যাটিন আমেরিকা থেকে এসেছিল। আমি এটা নতুন ধরনের একটা বই করছি। বইটি বিএ, বিএসসি ছাত্রদের কোর্সের জন্য উপযুক্ত হবে। এটা ২০টা মডিউলে বিভক্ত। মাঝে মধ্যে ফ্রাগমেন্ট থাকবে। ছোট ছোট পার্টে বিভক্ত থাকবে। প্রায় সময় লেখকরা নিউ মিডিয়া নিয়ে লেখে, কিন্তু পুরনোদের মতো বই-ই লেখে। আমি নতুন মিডিয়া নিয়ে নতুন আঙ্গিকে লিখছি এ বইটা।
প্রশ্ন : আপনি তো বাংলাদেশে আর একবার এসেছেন।উত্তর : নাহ। অন্তত ১০-১৫ বার।
প্রশ্ন : বিভিন্ন সময়ে এসেছেন। দেখেছেন। আমরা খানিকটা হতাশ থাকি যে আমাদের এখানে সিনেমার প্রত্যাশিত বিকাশ হলো না। কেন?উত্তর : একাত্তরের যীশু সিনেমাটা দেখেছো। আমার বইয়ে একটা লেখা আছে ছোট বোবা মেয়ে বাঁশি বাজাতে শিখেছে। সেই ছোট মেয়ে আমার চোখে বাংলাদেশের প্রতীক। ঠিক তেমন বেদের মেয়ে জোছনা বাংলাদেশের প্রতীক। বেদের মেয়ে জোছনা তিন পিতার কন্যা। তার তিনটা পরিচয় জন্মগত, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক। এটা কি ভালো মুভি নয়? আরেকটা মুভি আছে। যেটার কথা বইতে দিতে পারিনি। তারেক মাসুদের অন্তর্যাত্রা। আমি এটা খুবই পছন্দ করেছি। তারেককে বলেছিলাম, অন্তর্যাত্রার শেষ নেই।
প্রশ্ন : আপনার পছন্দের মুভি কোনগুলো?
উত্তর : আমি পছন্দ করি চেঞ্জ। এখন যেটা নিয়ে ভাবছি সেটা পরে হয়তো চেঞ্জ হয়ে যাবে। তারপরও কিছু মুভি আছে। ব্যাটেলশিপ পটেমকিন, বাইসাইকেল থিফ, দি ডায়রি অফ এ কান্টৃ পৃস্ট। দি ডায়রি অফ এ কান্টৃ পৃস্ট রবার্ট ব্রেসোঁর মুভি। তিনি আমার খুবই পছন্দের ফিল্ম মেকার। সত্যজিত রায়ের অপু টৃলজি ও শেষ পর্যায়ে করা টৃলজি।
Saturday, March 24, 2007
নিঃশব্দ (nishabd)-২০০৭
দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না এইটা বেশ বুঝতে পারলাম তথাকথিত ইনডিয়ান লোলিটা নিঃশব্দ দেখে। দুধের স্বাদ দুধে, ঘোলের স্বাদ ঘোলেই মেটাতে হয়। প্রথম যখন শুনেছিলাম রামগোপাল ভার্মা একটা সিনেমা তৈরি করছেন যা নাকি সামথিং লাইক লোলিটা হবে, তখনই মনে প্রশ্ন উঠেছিল, ইজ ইট পসিবল ইন ইনডিয়া? তাছাড়া ভূতের সিনেমা করে বিখ্যাত হওয়া রামগোপাল লোলিটার মতো বাঘা আইডিয়া নিয়ে সিরিয়াস কাজ করবেন কেমন করে?
লোলিটা বোধহয় সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত চরিত্র। এর গল্পটাও বাঘা সাহিত্যিকের,ভ্লাদিমির নবোকভের। এরকম প্যাশনদার গল্প খুব কমই আছে। তদুপরি ইনসেসটাস অবৈধ সম্পর্কের কথা। এ জিনিস নিয়ে সেই চল্লিশের দশক থেকে বিতর্ক চলছে তো চলছেই। আমার ভাগ্য ভাল, প্রথ ম দফা স্টানলি কুব্রিকের লোলিটাই দেখেছিলাম। আরও ভাগ্য যে, সে সিনেমার চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন স্বয়ং ভ্লাদিমির নবোকভ। সিনেমাটি সাদাকালো। কিন্তু তাতে কি ১৯৬২ তে বানানো ওই ছবিটাতেই বাধভাঙা প্যাশনের অবৈধ রঙগুলো সবচেয়ে বেশি ফুটিতে তোলা গিয়েছিল।
এর পর দেখলাম ১৯৯৭তে আদ্রিয়ান লেইনের বানানো লোলিটা। সম্পূর্ণ রঙিন। তবে চিন্তা একটু কম । প্যাশনটা সরাসরি দেখানোর প্রবণতা বেশি।
এর মধ্যে সিনেমার ইতিহাসে লোলিটা নামে অনেক নায়িকা এসেছে। কখনো দৈবাৎ কখনো নবোকভের আইডিয়ার সাজেশন হিসাবে। মনে আছে, আদ্রিয়ান লেইনের মুভিটা দেখার পর একটা গল্প লিখেছিলাম ২০০৪-এ। লোলিতা রিলোডেড। সেও এক প্যাশনের গল্প।
বেশ এইসব মাথায় থাকলে নিঃশব্দ ভাল লাগার কথা না। সারাক্ষণ নীলের আধিপত্য দিয়ে রামগোপাল অবৈধ, বাধভাঙা ব্যাপারের সাজেশন হয়তো দিতে চেয়েছেন। কিন্তু ওই নির্জন পাহাড়ি এলাকায়ও ইনডিয়ান মূল্যবোধ সমাজ সংসার হাজির করে রীতিমতো একটা নীতিকথার আসর বসিয়ে ফেলেছেন। সৎ বাপ তো দূরের কথা বান্ধবীর বাপের সঙ্গে প্রেমটাও তাই জমলো না। বাধ যদি নাই ভাঙবে তবে আর খামাখা লোলিটাকে টেনে আনা কেন?
কিন্তু এইটুকুতেই ইনডিয়ান সমাজের মাথায় গরম পানি পড়েছে। বিতর্ক চলছে। অমিতাভ কি করে এই অভিনয় করে হানি ঘটালেন এ নিয়েও কথা বার্তার শেষ নেই। অনেকে এই বিতর্কের জোরে কিংবা বিজ্ঞাপনের জোরেও দেখছেন বটে। কিন্তু আমি হতাশ।
রামুজিসে বারে মে ফিরছে সোসনা পড়েগা!
নেমসেক বিষয়ে মিরা নায়ার
সালাম বম্বে ও মুনসুন ওয়েডিং খ্যাত পরিচালক মিরা নায়ার এবার তৈরি করলেন নেমসেক। বাঙালি বংশোদ্ভূত লেখক ঝুম্পা লাহিড়ি এ উপন্যাসটির জন্যই পুলিটজার পুরস্কার পেয়েছিলেন। এতে আছে কলকাতা থেকে নিউ ইয়র্কে মাইগ্রেট করা দম্পতি আশোক ও অসীমার কাহিনী। আমেরিকান ডৃমের স্বপ্নে ৩০ বছর পার করার পরও এ দম্পতির জীবনে পুরনো মূল্যবোধ ও নতুন পৃথিবীর সংঘর্ষ থেকেই যায়। অন্যদিকে তাদেরই সন্তান গোগোল নিজেকে খুজে পায় আমেরিকান আইডেন্টিটির ভেতর। ইরফান খান, টাবু, কাল পেন অভিনীত মুভিটি ইতিমধ্যে বিশেষ সাড়া ফেলেছে। মুভি নিয়ে নিউজউইক ম্যাগাজিনের সঙ্গে কথা বলেছেন মিরা নায়ার।
নেমসেক কি নিয়ে তৈরি?
এটা মা ও ছেলের কাহিনী। আমারও একটি টিনএজ ছেলে আছে। আমি নিজের অভিজ্ঞতাকেই মুভিতে রূপায়িত করেছি। কিন্তু যে জিনিসটা আমাকে মুভি তৈরিতে উৎসাহ দিয়েছে তা হলো বঞ্চনা। এমন একটি দেশে বাবা-মাকে হারানো যা সম্পূর্ণ নিজের নয়। প্রথম বারের মতো মৃত্যুর অভিজ্ঞতা লাভ করা।
এটা বাড়ির গল্পও। আপনার নিজের বাড়িটা কোথায়? আপনার তো দিল্লি, নিউ ইয়র্ক, আফৃকায়... বাড়ি আছে।
নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর বিলাসের মধ্যে কিছু সুবিধা আছে। আমার বাড়ি সেখানেই যেখানে আমার পরিবার থাকে। আমি বাড়ি বানিয়েছি বসবাসের জন্য, খোলা জায়গায় নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য আর আশ্রয়ের জন্য। আমরা ম্যানহাটানে থাকি। আমার ছেলের স্কুল শেষ হলে আমরা ইউগান্ডার কামপালা যাই, সেখানে তিন মাস থাকি। একইভাবে আমার মুভি ও পরিবার প্রতি বছর আমাকে ইনডিয়ায় নিয়ে যায়। শুরুতে এক জায়গার জন্য আরেক জায়গা ছাড়ার ব্যাপারটা আমার জন্য বিভ্রান্তিকর ছিল। কিন্তু আমি এ বিভ্রান্তিটা মুভিতে ব্যবহার করার পর দেখলাম জীবনের অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমার যা নেই তার জন্য আমি এখন হা হুতাশ করি না। আমি প্রত্যেক জায়গায়ই পরিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করতে শুরু করেছি।
সিনেমাটি নিয়ে আপনার কি স্বপ্ন ছিল?
আমি একটি গভীর ও অপূর্ব প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমকাহিনী বানাতে চেয়েছি। গোগোলের বাবা-মার প্রেম কাহিনী এমনই যে, আমি সচরাচর এ রকম দেখি না। এটা নীরবতার গল্প। কিচেন টেবিলে এক কাপ চা দু’জনে শেয়ার করা, পরস্পরকে দেখার গল্প। সঙ্গ কাকে বলে ও অংশীদারিত্বের কৃৎকৌশল বলতে যা বোঝায় তার কাহিনী। তরুণদের গোলাপ, হিরা, হলমার্কের কার্ড, আই লাভ ইউর ব্যাপার নয়। মুভির দুটি খুটি হলো এ প্রাপ্তবয়স্ক প্রেম আর গোগোলের মানুষ হয়ে ওঠা। এমনকি ম্যানহাটানেও আমি তিন প্রজন্মের সঙ্গে বাস করি। আমার আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে থাকাটা আমার জন্য আনন্দদায়ক। কিন্তু আমেরিকা নিজেকে বার্ধক্যের প্রজ্ঞা থেকে বঞ্চিত করেছে। আমরা তাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছি।
ইনডিয়ান-আমেরিকানদের জীবন সম্পর্কে আপনার ধারণা কতোটা বাস্তব?
১৯৭৯ সালে আমি যখন নিউ ইয়র্ক যাই তখন লোকে ইনডিয়া প্রায় চিনতোই না। খুব ভয়ঙ্কর একাকী সময় ছিল সেটা। আমি এখন ইন্টারনেটে কিক করলেই দক্ষিণ এশিয়ান নাট্যকার, পাঠচক্র, ফিল্ম ফেস্টিভাল- সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির পুরো একটা উপরিকাঠমোই দেখতে পাই। ঝুম্পা লাহিড়ি ও আমার জগৎ কসমোপলিটান। আমরা শিল্প, কলেজ নেটওয়ার্ক, প্রতিবাদ ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত। গোগোলের মাধ্যমে মুভিটিতে কলকাতা ও ম্যানহাটানের সমন্বয় ঘটেছে। সত্তরের দশকের যে কলকাতা আমি ভালোবাসতাম আর ম্যানহাটানের সেই সঙ্গীত, ফ্যাশন, মানুষ যারা রাস্তায়, বারে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
তার মানে মুভিটি দুই শহরের কাহিনী?
কলকাতা আমার জন্য বিশেষ এক শহর। এ শহরের তিনশ’ মাইল দক্ষিণে আমি বেড়ে উঠেছি। গ্রীষ্মের ছুটিগুলো সেখানে কাটিয়েছি। আমি পরে যা হয়েছি তার অনেক কিছুই সেখানে শেখা। সেখানেই আমি প্রথম রাজনৈতিক পথনাটক পেয়েছি। প্রথম মুভি দেখেছি। মহান বাঙালি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের দেখা পেয়েছি। ১৮ বছর বয়সে আমি ক্যামবৃজে এসেছি যেখানে নেমসেকের সূচনা। তারপর আমি নিউ ইয়র্কে গিয়েছি। মুভিটি ওই দুই শহর নিয়ে যেখানে আমি শিখেছি, বড় হয়েছি আর দেখেছি। আমি এ দুই শহরকে এমনভাবে চলচ্চিত্রায়িত করেছি যেন সেগুলো একটা শহর। কারণ আমি বিশ্বাস করি, কলকাতা আর ম্যানহাটানের মধ্যে অনেক মিল আছে। এটাই হলো বয়নের সূত্র। দর্শককে ধারণা দেয়া যে, দুই পৃথিবীতে বাস করাটা কেমন হতে পারে। কখনো কখনো আমরা জানি না, আমরা নিউ ইয়র্ক না কলকাতায় আছি।
(সংক্ষেপিত)
অনুবাদ : মাহবুব মোর্শেদ
Saturday, March 10, 2007
ব্রিফ ক্রসিং (২০০১)
ফরাসি পরিচালক ক্যাথেরিন ব্রেইলার সিনেমা ব্রিফ ক্রসিং। সিনোমটি দেখে কিঞ্চিত উত্তেজিত হয়েছিলাম। পরে জানতে পেরেছিলাম পরিচালক কিঞ্চিত বিতর্কিত আছেন। এইটা ছোট এক প্রেম কাহিনী। ব্রিফ। আশি মিনিটের। কিন্তু একটুও পলক ফেলার উপায় নাই। কাহিনী তৈরি হয়েছে ডেভিড লিনের উপন্যাস ব্রিফ এনকাউন্টার থেকে। কাহিনী এক রাতের। জাহাজে দেখা হয় ত্রিশোত্তর এক ইংলিশ নারী এলিসের সঙ্গে দেখা হয় ১৬ বছরের ফ্রেঞ্চ স্কুল বয় থমাসের। পরিচয় ও আলাপ চলে। গাঢ় হয়ে ওঠে সম্পর্ক। স্রেফ এক রাতের ব্যাপার। এলিস বলে, সে স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে ফিরছে। তার মনে দুঃখ। আর সেক্স ও সম্পর্ক বিষয়ে সে মুক্তমনা। অমুক তমুক। থমাস তার বক্তব্যে উৎসাহী হয়। সে তখনো সে ভার্জিন। টিনেজ বেলায় যেমন হয়, সে সিরিয়াসলি প্রেমে পড়ে। রাতে তাদের মধ্যে সেক্সুয়াল এনকাউন্টার হয়। সকালে থমাসের জন্য অপেক্ষা করবে বলেও অপেক্ষা না করে চলে যায় এলিস। দৌড়াতে দৌড়াতে থমাস শেষ পর্যন্ত এলিসের গাড়ি পর্যন্ত যায় সে। তাকে নিতে এসেছে তার স্বামী। কোলে তার সন্তান। থমাসের দিকে ফাঁকা দৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু তার দিকে চোখ পড়ে না। অবাক কাণ্ড। থমাস ভীষণ আহত অবস্থায় বেদনার্ত হয়ে ওঠে। এটাই যেন ব্রিফ এনকাউন্টার বিটুইন লাভ অ্যান্ড সেক্স।
Thursday, March 8, 2007
ভগম ভগ (২০০৬)
মালায়লম সিনেমা রামজি রাও স্পিকিং থেকে হিন্দি সিনেমা হেরা ফেরি তৈরি হয়েছিল। রামজি রাও স্পিকিং-এর সিকোয়েল মান্নার মাথাই স্পিকিং। সেই মান্নার মাথাই স্পিকিং-এর রিমেক হলো ভগম ভগ। ফলে, ভগম ভগ হলো সম্পর্কে ফির হেরা ফেরির চাচাতো ভাইয়ের মামাতো বোনের ননদের ভাশুর। বলাবাহুল্য এইটাও কমেডি মুভি। পরেশ রাওয়াল একটা থিয়েটার চালান। সেইখানে অক্ষয় আর গোবিন্দ নায়িকার ডিস্টার্ব নষ্ট করে। তাই নায়িকা ভেগে যায়। কিন্তু দলকে লন্ডনে শো করতে হবে। সেখানে গিয়ে নায়কদের নায়িকা খুঁজে বের করতে হবে। নায়িকা খুড়তে গিয়ে তারা এক সাপের খোড়ল খুঁজে পায়। আর যায় কোথায়? সিরিয়াস আবহে কিঞ্চিত কম্মেডি। অত হংস করা গেল না বটে, তবে সাঁতার মোটামোটি কাটা গেল। পরিচালক প্রিয়দর্শন। আর মূল লড়কি লারা দত্ত।
রাজকুমার সন্তোষীর চায়না গেট (১৯৯৮)
চায়না গেট নামে হলিউডে ১৯৫৭ সালে একটা মুভি তৈরি হয়েছিল। পরিচালনা করেছিলেন সামুয়েল ফুলার। এই চবি নিয়া আমি কিছু জানি না। কারণ দেখি নাই সেটি। তবে রাজকুমার সন্তোষীর চায়না গেট দেখলাম সম্প্রতি, এগেইন। উর্মিলা মার্তণ্ডকারের ছাম্মা ছাম্মা গানের গগনবিদারী অ্যাপিল যে মোলাঁ রুজকেও প্রভাবিত করেছিল তা জানা ছিল না। জানলাম উইকিপিডিয়া ঘেটে। এই গানটা তো আসলে আইটেম সঙ। মানে স্রেফ উর্মিলার উপস্থিতির জন্যই। উর্মিলা ছাড়াও ছিলেন এককালের কুল বলিউডি আইটেম মমতা কুলকার্নি। না, হট নন তিনি চায়না গেটে বেশ কুলই ছিলেন।
অভিনয় করেছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরি, অমরেশ পুরি, পরেশ রাওয়াল, ড্যানি ডেনজঙপাসহ হাই প্রোফাইল অনেক বলিউড অভিনেতা।
পার্বত্য অঞ্চলে এক ছোট একটি অঞ্চলে ডাকারদের ব্যাপক উপদ্রব চলছে। সেখানকার এক ফরেস্ট অফিসারের আমন্ত্রণে ওই জনগোষ্ঠীকে বাচাতে যায় প্রাক্ত আর্মির একটি দল। ডাকাত দলের সঙ্গে লড়াইয়ে বেশ কয়েকজন নিহত হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজয় লাভ করে তারা। এক সময়ের সুপার হিট এই মুভিটি নিয়ে রিলিজ হওয়ার সময় কে কী বলেছিলেন জানি না। কিন্তু এই মুভিটা একটি বিখ্যাত মুভির আদলে তৈরি। সেট, গল্প এবং মেকিং সহ সেই মুভির ব্যাপক প্রভাব আছে এতে। সেটা স্বীকার করা হয়েছিল কিনা তাও আমি জানি না। সেই বিখ্যাত মুভিটির নাম সেভেন সামুরাই। আকিরা কুরোশাওয়া পরিচালিত মুভি। ওই মুভিটিতে সাতজন সামুরাই যোদ্ধা ডাকাত অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলের এক জাতিগোষ্ঠীকে বাঁচাতে গিয়েছিল। সেখানকার এক তরুণীর প্রেমে পড়েছিল সামুরাই দলের তরুণতম যোদ্ধা। নিহত হয়েছিল কয়েকজন সামুরাই। আর নেমে ছিল এক অক্লান্ত বৃষ্টি।
চায়না গেট দেখে বারবার আমার সেভেন সামুরাইয়ের কথাই মনে পড়ছিল। থ্যাঙ্কস টু কুরোশাওয়া। হিন্দি পপ মুভিকেও কী দারুণ প্রভাবিত করেছিলেন!
Tuesday, March 6, 2007
লুই মান্দোকির ভোসে ইনোসেনটে (২০০৪)
এক রাতে চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাত স্টার মুভিজে আঙ্গুল থেমে গেল। গভীর রাতে ইংরেজি ছড়া অন্যভাষার ফিল্মগুলো মোটামুটি বিজ্ঞাপনের ঝামেলা ছাড়াই দেখা যায়। কিন্তু একটা অসুবিধা হচ্ছিল। বিজ্ঞাপন বিরতি নেই তাই হয়তো সিনেমাটার নামও দেখা হলো না। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম সিনেমাটা ভাল। নামে কি বা আসে যায়? ডিরেক্টিং স্টাইলও আমার পরিচিত না। অভিনেতা অভিনেত্রীদেরকেও চিনি না। ভাবলাম, পরে ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে নিশ্চয়ই জানা যাবে। সিনেমায় একটা চরিত্রের নাম ছিল চাভা। চাভার মার নাম কেলা। চাভা আর কেলা সার্চ দিয়ে পেয়ে গেলাম সিনেমার নাম ও ডিটেইল। স্পানিশ ভাষার এই সিনেমাটির ডিরেক্টর মেক্সিকান পরিচালক লুই মান্দোকি। মান্দোকির আরও কয়েকটি বিখ্যাত মুভির পরিচালক। মেসেজ ইন এ বোটল, হোয়েন এ ম্যান লাভস এ উওমেন তার মুভি। বলাবাহুল্য এইগুলা এখনও দেখা হয় নাই।
ভোসে ইনোসেনটে অর্থ ইনোসেন্ট ভয়েস।এটি তৈরি হয়েছে অস্কার টোরের শৈশবের অভিজ্ঞতার আলোকে। প্রেক্ষাপট ১৯৮০'র দশকের এল সালভাদর। সেখানকার শহরতলীর ১১ বছর বয়স্ক এক বাচ্চা চাভা। স্কুল ছাত্র। সিভিল ওয়ার চলছে। বাবা হারা পরিবারে চাভাই কর্তা। কাজ করে স্কুলে পড়ে। আর এমার্জেনসির মধ্যে যাপন করে দুঃসহ শৈশব। হঠাত গোলাগুলি। হঠাত আক্রমণ। স্কুলে আর্মি রেইড দিয়ে চাভার বয়সী ছেলের ধরে নিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে আর্মিতে ভর্তি করে। চাভার মূল সংগ্রাম হয়ে পড়ে যুদ্ধ এড়িয়ে নিজের শৈশবকে পাহারা দেয়া। এক সময় সকল কৌশল ব্যর্থহবার জোগাড় হয়। আর্মির হাত থেকে বেঁচে যাওয়া চাভা ও তার বন্ধুরা ভাবে, আর্মিতে যাওয়ার চেয়ে গেরিলা দলে যাওয়াই ভাল। গভীর রাতে গেরিলা ক্যাম্পে যায় তারা। ওই রাতেই রেইড হলে ধরা পড়ে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে আকিস্মক গেরিলা আক্রমণে বেঁচে যায় চাভা। বাড়ি ফিরে দেখে পুরো গ্রাম পুড়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই মার সঙ্গে দেখা হয়। তিনি লুকিয়ে তাকে আমেরিকা পাঠাবার ব্যবস্থা করেন।
সিনেমাটিতে এল সালভাদরের বিপন্ন অবস্থা, মানুষের অসহায়ত্ব, চার্চের এক ফাদারের সঙ্গে গেরিলাদের সম্পর্ক, শৈশবের প্রেম এত সূচারুভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে অবাক হতে হয়।
এই গৃহযুদ্ধ চলেছিল ১২ বছর।
কী অসহনীয় যে ওইসব গৃহযুদ্ধ!
মিস্টার অ্যান্ড মিসেস স্মিথ (২০০৫)
মেলাদিন সিনেমা দেখা হয় না। ডেইলি রুটিন একটু এলোমেলো হওয়ায় সিনেমা দেখা কমে গেছে। এর মধ্যে দেখলাম মি. অ্যান্ড মিসেস স্মিথ।
দাম্পত্য যুদ্ধের মুভি। অভিনয় করেছেন ব্রাড পিট ও অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। জন স্মিথ ও জেন স্মিথ। বলা হয় এই মুভিতে অভিনয় করার সময় তারা ব্রাড ও জোলি ইশকে ফেঁসে গিয়েছিলেন। যার ফল হিসাবে গত বছর একখানা বাচ্চাও জন্ম দিয়েছেন তারা।
মি. অ্যান্ড মিসেস স্মিথ ছয় বছরের দাম্পত্য জীবনে জানতে পারেনি তার স্বামী বা স্ত্রী সেক্রেট এজেন্ট হিসাবে কাজ করে বা গুপ্ত হত্যা অভিযানে তারা দুজনেই দক্ষ যোদ্ধা। কিন্তু ম্যারেজ কাউনসেলিং-এর সময় ব্যাপারটি বেরিয়ে আসে। বিপক্ষ দুই সংস্থার হয়ে কাজ করতো মি. অ্যান্ড মিসেস স্মিথ। সংস্থা দুটি একে অপরকে হত্যা করার জন্য তাদের দুজনকে নিয়োগ দেয়। শুরু হয় জন বনাম জেন যুদ্ধ। অস্ত্র সজ্জিত হয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে পরস্পরের ওপর লাফিয়ে পড়ে। সে এক আশ্চর্য যুদ্ধ। বেডরুম, কিচেন সর্বত্র এক টানটান উত্তেজনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরস্পরের প্রতি আস্থা ফিরে আসে তাদের। এবং যৌথভাবে শত্রুর মোকাবেলা শুরু করে তারা। আর শেষে যা হয়... জয়ী হয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে।
কিন্তু সিনেমাটি দেখে আমার বারবার একটি সশস্ত্র দাম্পত্য কলহে রক্তপাতহীন টানটান যুদ্ধের আইডিয়াটি বিশেষ পছন্দ হয়েছে। বাকী থাকলো অ্যাকশন। এ আর নতুন কী?
তবে ব্রাড ও জোলির বাচ্চাটা কিন্তু নতুন। যদিও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখিলে পৃথিবীতে শিশুর ন্যায় পুরাতন আর কিছুই নাই।
Monday, March 5, 2007
অক্টোপুসি (১৯৮৩)
জেমস বন্ডের যে সিনেমাগুলো দেখা হয়নি তার মধ্যে অক্টোপুসি অন্যতম। সেদিন হঠাৎ দেখার সুযোগ হলো। সিনেমাটা দেখতে দেখতে একটু শিহরিত হচ্ছিলাম। কোনো রোমান্স, সাসপেন্স, থ্রিল নয়, ভারতের পটভূমিতে অক্টোপুসির কাহিনীর অনেকটা ঘটেছে এটা দেখে ভাল লাগছিল। অক্টোপুসির গল্পটা ইয়ান ফেমিং লিখেছিলেন ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৬ পর্যন্ত ব্রিটিশ ইনডিয়ার স্মৃতি হয়তো তাকে বিষণ্ন করে তুলতো। ফলে তার নায়ক সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট দুষ্টলোকের পেছন পেছন ইনডিয়ায় চলে এসেছে। আর সে ইনডিয়ার অনেকটাই ব্রিটিশ ইনডিয়া। অর্থাৎ অরিয়েন্টাল ইন্ডিয়া। রহস্যমানবী অক্টোপুসি শাড়ি পরে অভিনয় করছেন। তার দলের সদস্যরাও মোটামুটি নিজেদের সাজ পোশাকে অরিয়েন্টাল ভাবধারা সাঙ্গ করেছেন।
আফগান রাজপুত্র, ভারতীয় ভিলেন আর সোভিয়েত সামরিক কর্মকর্তা বিরুদ্ধে জেমস বন্ড আর অক্টোপুসি। মাঝখানে তাদের পেয়ার মহব্বত।
ভিলেনরা আনবিক বোমা ফোটাবে আমেরিকান মিলিটারি বেসে। জেমস বন্ড প্রতিহত করলো সে অভিযান। আর সুখে শান্তিতে মৌজ করতে থাকলো।
সে তো পুরনো কাহিনী। কিন্তু জেমস বন্ডের ইনডিয়া সত্যিই ইন্টারেস্টিং।
এই পোস্টটা সামহোয়ার ইন ব্লগে করার পর তিমির বললেন, ইয়ান ফ্লেমিংয়ের কাহিনীতে ইন্ডিয়া প্রসঙ্গ নেই। তার মানে এটি বিশেষভাবে ডিরেক্টরের সৃষ্টি। মুভিটির ডিরেক্টর জন গ্লেন।
পদ্মানদীর মাঝি
এইচএসসি কোর্সে আমাদের পদ্মানদীর মাঝির প্রথম চ্যাপ্টারটা পড়ানো হতো। বাংলাদেশে এইচএসসি পাশ অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি আছেন যারা স্রেফ ওই একটি চ্যাপ্টারকেই পদ্মানদীর মাঝি ভাবেন। ওই চ্যাপ্টারটা পদ্মানদীর মাঝির অংশ বটে, কিন্তু পদ্মানদীর মাঝি না। ইন্টারমেডিয়েটেই উপন্যাসটি পড়ার সুবিধা হয়েছিল আমার। পুতুল নাচের ইতিকথা পড়ার পরও এইটাই আমার প্রিয় উপন্যাস থেকে গিয়েছিল। সুমন চৌধুরী ছাড়া আমার পরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে আর কেউ পুরো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়েছেন বলে জানি না। ফলে তিনিই বলতে পারবেন মানিকের রচনাবলীর মধ্যে পদ্মানদীর মাঝি, পুতুলনাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য এই তিনটার সঙ্গে আর কোনগুলো এককাতারে বিবেচিত হতে পারে।
উপন্যাসটি পড়ার পর বিশেষ করে একটি বিষয় আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। একটি চরিত্র আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল। চরিত্রটির নাম হোসেন মিয়া। বিষয়টির নাম ময়নাদ্বীপ। অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম আহমদ ছফাকে এই বিষয়টি আলোড়িত ও চিন্তিত করছিল। তিনি বাঙালি মুসলমানের মন বইয়ে এ সংক্রান্ত দারুণ একটা প্রবন্ধ লিখেছেন।
১৯৯৩ সালে যখন পদ্মানদীর মাঝি সিনেমা হলো তখনও ভাল সাহিত্য বনাম সিনেমার সংঘর্ষ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা রাখি না। কুষ্টিয়া শহরে পদ্মানদীর মাঝির বিশাল পোস্টারে চম্পা ও রূপা গাঙ্গুলির মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু এত বছরেও গৌতম ঘোষ পরিচালিত এই সিনেমাটি দেখা হয়েছিল না। দেখলাম সেদিন। ২০০৭ সালের মার্চে। ভারতের একটা টিভি চ্যানেলে। ডিভিডি কেনার কথাও চিন্তা করলাম দেখার পর। কারণ সিনেমাটা আমার ভাল লেখেছিল।
যতদূর মনে আছে শুটিং-এর সময় গৌতম গোষ বাংলাদেশে এসে বলেছিলেন সে পদ্মাও নাই সে পদ্মানদীর মাঝিও নাই। কিন্তু তার মধ্যেও তিনি পদ্মানদীর মাঝিকে সার্বিকভাবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে ফোকাস করেছেন ময়না দ্বীপকে। আমার মতে, মানিকের ফোকাসেও মূলত ময়নাদ্বীপই ছিল। পরিপ্রেক্ষিতের প্রয়োজনে পদ্মাপার, দারিদ্র ইত্যাদি এসেছে। ফলে পদ্মানদীর মাঝি আমার ভাল লেগেছে। উৎপল দ্ত্ত ছাড়া আর কে যে হোসেন মিয়া হতে পারতো? ভাগ্যিস তার মৃত্যুর আগে সিনেমাটা শেষ হয়েছিল।
Sunday, March 4, 2007
মোটর সাইকেল ডায়েরিজ (২০০৪)
২০০২ সালের কোনো এক সকাল বেলা আমি আর গল্পকার প্রশান্ত মৃধা মৌলভীবাজারের শমশেরনগরের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলাম। উদ্দেশ্য শুভাশিস সিনহাদের ওখানে রাস উৎসব দেখবো। আমার হাতে ছিল এক কপি মোটর সাইকেল ডায়েরি। আর্নেস্তো চে গুয়েভারার তরুণ বয়সের ভ্রমণ কাহিনী। শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত রাস্তায় টানা পড়ে পুরো বইটা শেষ হলো। একটা ঘোর আমাকে ঘিরে ধরেছিল তাৎণিকভাবে। ভাবছিলাম এই বিপ্লবী আইকনের লাতিন আমেরিকা ভ্রমণের উদ্দাম অভিযানটি শেষ হয়েছিল আমার তখনকার বয়সের আগে। ওই সময়েই তিনি আর্হেন্টিনা, চিলি, পেরু, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা ভ্রমণ শেষ করে ফেলেছেন। লাতিন আমেরিকার মানুষের স্পিরিটটাকে বুঝতে পেরেছেন। আহা আমরা এখনও বাংলাদেশটাও দেখলাম না। আর্নেস্তো ও আলবার্তোর এই ভ্রমণ শুধু একটি ভ্রমণ নয়। পরের ইতিহাসের একটি প্রস্তুতিও। বহুবছর এই ডায়েরি ও ভ্রমণ অনেক তরুণকে অনুপ্রাণিত করেছে। ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তে।
বইটি পড়ার বহুদিন পর দেখলাম মোটর সাইকেল ডায়েরিজ মুভিটা। ওয়ালটার স্যালেস পরিচালিত মুভিটা দেখার আগে স্বাভাবিকভাবে আশা করেছিলাম, এটা আমাকে আশাহত করবে। সাধারণত অধিকাংশ বিখ্যাত বইয়ের মুভিরূপের ক্ষেত্রেই তা ঘটে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ততোটা আশাহত হইনি, যতটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।
আবার ওই বইটার কথা মনে পড়লো মুভিটা দেখে।
Subscribe to:
Posts (Atom)